সংলাপে সংস্কার নয়, মতবিরোধই মুখ্য ২০ সিদ্ধান্তের ৯টিতে ঐকমত্য হয়নি, ৪টি সিদ্ধান্তে সরাসরি নারাজ বিএনপি

নির্বাচন-পূর্ব মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে ঐকমত্যের সংলাপ থেকে আশানুরূপ সমঝোতা আসেনি। ২০টি প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে ৯টিতেই কোনও না কোনও দল আপত্তি তুলেছে। বিশেষ করে চারটি বিষয়ে বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা বাস্তবায়নে রাজি নয়। জামায়াত ও এনসিপিও কয়েকটি বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে। এ অবস্থায় আলোচিত ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

বিএনপি চারটি সংস্কার পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে:

১. ভোটের অনুপাতে (PR) উচ্চকক্ষ গঠন
২. প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে থাকতে পারবেন না
৩. সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (দুদক, পিএসসি, সিএজি, ন্যায়পাল) নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠন
৪. প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগে র‍্যাঙ্ক চয়েস ভোট ব্যবস্থা

তিনটি বিষয়ে আপত্তিসহ (নোট অব ডিসেন্ট) একমত:

• সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংশোধন

• প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সিনিয়র বিচারক বাছাই

• রাষ্ট্রপতির নিয়োগ ক্ষমতা প্রসঙ্গে কিছু প্রতিষ্ঠান বাদ দেওয়া

জামায়াতের আপত্তি:

জামায়াতে ইসলামী সরাসরি নির্বাচনে নারীদের দলীয় মনোনয়নে রাজি হয়নি। তারা বরং পিআর পদ্ধতিতে নারীসংখ্যা বাড়িয়ে ১০০ করতে চায়।

এনসিপি চায় আরও বেশি নারী প্রতিনিধিত্ব

৭ শতাংশ নয়, তারা চায় ১৫ শতাংশ নারী প্রার্থী বাধ্যতামূলকভাবে মনোনয়ন দেওয়া হোক।

১১টি সিদ্ধান্তে সর্বদলীয় ঐকমত্য

সংলাপে একমত হওয়া ১১টি সিদ্ধান্ত হলো:

• একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন

• স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন

• জরুরি অবস্থা জারিতে বিরোধী নেতার সম্পৃক্ততা

• মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ

• গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন

• গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন

• বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ

• হাইকোর্ট বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে স্থাপন

• উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপন

• রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ক্ষমতা আইনে সীমিতকরণ

• সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসে সাংবিধানিক কমিটি

একাধিক বিষয়ে গভীর মতবিরোধ

PR পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিতকরণ ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক কমিটি গঠনে সবচেয়ে বেশি বিরোধ দেখা দিয়েছে।

জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ ২১ দল PR পদ্ধতি সমর্থন করলেও বিএনপি ও সমমনা পাঁচটি দল তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
সিপিবি, বাসদ, জাসদ সংবিধানে “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার” সংযোজনের প্রস্তাবেও রাজি হয়নি। তারা ‘আল্লাহর উপর আস্থা’ পুনর্বহালের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।

বিএনপির অবস্থান

বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে “জুলাই সনদে সই করলেও, ক্ষমতায় গেলে চারটি সিদ্ধান্ত তারা বাস্তবায়ন করবে না।”

তাদের মতে, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “নির্বাহী বিভাগকে দায়িত্বের সঙ্গে ক্ষমতাও দিতে হবে, না হলে ভারসাম্য নষ্ট হবে।”

জামায়াত ও এনসিপির যুক্তি

জামায়াতের ডা. তাহের বলেন

“প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে দুদক, পিএসসি, সিএজি স্বাধীন হতে হবে। পিআর পদ্ধতি সংবিধানের সুরক্ষায় সহায়ক।”

এনসিপির আখতার হোসেন বলেন

“নারী প্রতিনিধিত্ব ১৫ শতাংশ না হলে প্রকৃত ভারসাম্য আসবে না। তত্ত্বাবধায়কের নিয়োগ নিয়ে নির্দিষ্ট রূপরেখা না থাকলে আবারও বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।”

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বিভক্ত মত

কমিশন প্রস্তাব করেছিল—অর্থবিল ছাড়া এমপিরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। বিএনপি ও জামায়াত বলছে, আস্থা ভোট, জাতীয় নিরাপত্তা ও সংবিধান সংশোধনেও দলীয় সিদ্ধান্তই থাকতে হবে।

এ সিদ্ধান্তে কেউ পুরোপুরি একমত নয়। কেউ নোট অব ডিসেন্ট, কেউ সীমিত সমর্থন দিয়েছে।

নারী প্রতিনিধিত্ব ও ধর্মীয় দলগুলোর আপত্তি

জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ ছয়টি ধর্মভিত্তিক দল সরাসরি নারী প্রার্থী মনোনয়নের বাধ্যবাধকতায় রাজি নয়। তারা সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বাড়ানোর পক্ষে।

সংলাপের ভবিষ্যৎ

কমিশন জানিয়েছে, দু’এক দিনের মধ্যেই জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া হবে।
সেখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ থাকবে—

• কোন সিদ্ধান্তে একমত

• কোনটিতে আপত্তিসহ সম্মতি

• কোনটি বাস্তবায়নে অরাজি

যদিও সই হওয়ার কথা ছিল সনদে, বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা নিয়ে দলগুলোর অনীহা সনদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।