সাদেকুল ইসলাম রুম্মান: পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী পাচ্ছে না দেশের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও কর্মসংস্থানে কারিগরি শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ওই খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতি বছরই দেশের ওসব টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজগুলোর (টিএসসি) আসন শূন্য থাকছে প্রায় ৬২ শতাংশ। তারপরও দেশে টিএসসির সংখ্যা বাড়ছে। বিগত সরকারের সময় কারিগরি শিক্ষা খাতে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প নেয়া হয়। তার মধ্যে ৪২৯টি উপজেলায় ৪২৯টি টিএসসি নির্মাণের দুটি প্রকল্প অন্যতম ছিলো। তার মধ্যে একটি প্রকল্পে ১০০টি এবং আরেকটি প্রকল্পের অধীন ৩২৯টি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ হচ্ছে। চলতি বছর পর্যন্ত সেগুলোর মধ্যে ৯১টি টিএসসিতে শুরু হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। কিন্তু ওসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের পদ প্রায় ৫০ শতাংশ শূন্য। প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ শিক্ষক ও প্রচারণার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পর এখনো কোনো শিক্ষাবর্ষেই আসন সংখ্যা অনুযায়ী শিক্ষার্থী পায়নি। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্প দুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো সম্পন্ন হয়নি ৩৩৮টি টিএসসির নির্মাণকাজ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল এমন ১৪৯টি টিএসসির প্রায় ৬২ শতাংশ আসনই ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ফাঁকা ছিলো। তার মধ্যে ১৩৬টি টিএসসিতে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিলো। ওসব প্রতিষ্ঠানে মোট ২৬ হাজার ৬৫০টি আসন সংখ্যা। আর শিক্ষার্থী ভর্তি হয় ১০ হাজার ৬০৩ জন। অর্থাৎ প্রায় ১৬ হাজার ৪৭টি আসনই শূন্য ছিলো। যা মোট আসনের ৬০ দশমিক ২১ শতাংশ। এসএসসি (ভোকেশনাল) ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) কোর্সেও এমনই চিত্র। এসএসসি (ভোকেশনাল) কোর্স চালু থাকা ১৪৯টি প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ৬০০টি। কিন্তু ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ৩৮ হাজার ৬২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। ফলে ৬৬ হাজার ৯২০টি আসন ফাঁকা ছিল, যা মোট আসনের ৬৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর এইচএসসি (ভোকেশনাল) কোর্সে ১৪৯টি প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যা ২৪ হাজার ৫০টি কিন্তু শিক্ষার্থী ভর্তি হয় ৯ হাজার ৯৯ জন। আসন ফাঁকা ছিল ১৪ হাজার ৯৫১টি, যা মোট আসনের ৬২ দশমিক ১৬ শতাংশ।
সব মিলিয়ে ১৪৯টি প্রতিষ্ঠানে মোট আসন দেড় লাখেরও বেশি ছিল। আর নির্মাণাধীন ৩৩৮টি প্রতিষ্ঠান চালু হলে আরো প্রায় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৯২০টি আসন বাড়বে। কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের প্রি-ভোকেশনাল এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত কমপক্ষে চারটি করে ট্রেডে পড়াশোনা করানো হয়। তাছাড়া এসএসসি (ভোকেশনাল) ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) কোর্সসহ বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বর্তমানে সব কোর্স চালু আছে এমন প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ আসন ফাঁকা থাকছে। আগের ৬৪টিসহ বর্তমানে ১৫৫টি টিএসসির কার্যক্রম চালু রয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশের কারিগরি শিক্ষায় আধুনিক কারিকুলাম ও পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। তাছাড়া কারিগরি শিক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের নেতিবাচক ধারণা, কারিগরি শিক্ষার সঠিক প্রচার না থাকা এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে ওসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী আকর্ষণে ব্যর্থ হওয়ায় বিপুলসংখ্যক আসন ফাঁকা থাকছে। ওসব সংকট নিরসন না করলে কারিগরি শিক্ষা থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না। তাছাড়া উন্নত কারিগরি যন্ত্রাংশের অভাব এবং কারিগরি পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষক সংকটও তীব্র। সেক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে উন্নত যন্ত্রাংশ ও কারিকুলাম আধুনিকায়ন জরুরি।
সূত্র আরো জানায়, দেশে কারিগরি শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো বিদেশী শ্রমবাজারের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি করা। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। তার মধ্যে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা মাত্র ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৪, যা গত বছর মোট বিদেশগামী কর্মীর ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। একই সময়ে স্বল্পদক্ষ কর্মী (অদক্ষ) হিসেবে বিদেশে গেছেন ৪ লাখ ৯১ হাজার ৪৮০ জন বা ৫৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। অথচ জনশক্তি রফতানির অর্ধেকের বেশি অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে যাচ্ছে। তাছাড়া আধা-দক্ষ কর্মী হিসেবে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১২৮ জন বা ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বিদেশে গেছেন। মূলত বাজারের চাহিদার তুলনায় কারিগরি শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে রয়েছে।
এদিকে দেশের কারিগরি শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মাধ্যমিক স্তর শেষে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির পর ডিগ্রি নিয়েও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেকার থাকছে। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ কর্মজীবী, ৪ শতাংশ উদ্যোক্তা, ৩৮ শতাংশ বেকার ও ৪ শতাংশ কাজে আগ্রহী নন। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার বেশি। গ্রামাঞ্চলে মাত্র ৪৮ শতাংশ ডিপ্লোমাধারী কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন। ওই কর্মজীবীদের ৬৫ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, ২৪ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে, ৬ শতাংশ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা এনজিওতে ও ৫ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।
অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক আসন ফাঁকা থাকার বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন জানান, বাংলাদেশকেও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে হলে কারিগরি শিক্ষায় জোর দিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ কারণেই প্রতিষ্ঠান বাড়ানো হচ্ছে। তবে এখানে শিক্ষক সংকট, প্রচারণার ঘাটতি, কারিগরি শিক্ষার বিষয়ে জনসচতেনতার অভাবসহ বেশকিছু সংকট রয়েছে, যা কারিগরি শিক্ষার প্রসারে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। বিশেষত কারিগরি শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নেতিবাচক ধারণা এক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। বেশির ভাগ মানুষই এ শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগ ও গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত নন। অভিভাবকরা এখনো মেধাবী সন-ানকে কারিগরি প্রতিষ্ঠানে পড়াতে চান না। তাছাড়া সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও চায় না তাদের শিক্ষার্থীরা কারিগরিতে আসুক। নানাভাবে তারা শিক্ষার্থীদের বাধাগ্রস্ত করে। ওসব কারণেই আসন ফাঁকা থাকে। সেজন্য প্রচারণা বৃদ্ধি এবং কর্মক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়ন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ফলে শিক্ষার্থীরা এ ধারায় আগ্রহী হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক সংকট দ্রুত নিয়োগের মাধ্যমে দূর করা হচ্ছে। সমপ্রতি নতুন প্রায় ১ হাজার ৬০০ শিক্ষক যোগদান করেছেন। তবে এ খাতে শিক্ষার্থী বৃদ্ধিতে সরকারকে অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি নীতিগত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন ধারায় কতসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকবে, সেগুলোয় কত শিক্ষার্থী পড়বে তা সুনির্দিষ্ট করে দেয়া প্রয়োজন।