সাদেকুল ইসলাম রুম্মান: চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট চালুর উদ্যোগকে ঘিরে ব্যবসায়ী মহলে প্রত্যাশা তৈরি হলেও বাস্তবায়নের গতি আশানুরূপ নয়। জুলাই মাসে অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ শুরু হলেও অগ্রগতি ধীর। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ কার্যক্রম শুরু হতে পারে। তবে বাস্তবতা হলো, বিমানবন্দর এখনো আন্তর্জাতিক মানের কার্গো অপারেশনের জন্য প্রস্তুত নয়। জানা যায়, চলতি বছরের ৮ এপ্রিল ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া দীর্ঘদিনের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে। এর ফলে ইউরোপে পণ্য পাঠানো নিয়ে রপ্তানিকারকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। এতদিন বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর হয়ে কলকাতা ও দিল্লি বিমানবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হতো। এই রুটটি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চাপ কমানোর পাশাপাশি দ্রুত ও কম খরচে বিকল্প সুবিধা দিচ্ছিল। শিল্পখাতের হিসাবে, অফ-সিজনে বাংলাদেশের পোশাক চালানের প্রায় ১৮ শতাংশই এই রুটে সম্পন্ন হতো। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পর সরকার বিকল্প হিসেবে সিলেট ও চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এখন চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট চালুর পথে সবচেয়ে বড় বাধা অবকাঠামো ঘাটতি। আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হলে এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস) স্ক্যানার স্থাপন অপরিহার্য। অথচ এখনো বিমানবন্দরে এ ব্যবস্থা নেই। হিমাগার ও আধুনিক কার্গো শেড নির্মাণের কাজও শুরু হয়নি। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসব কাজ শেষ করতে আরও কয়েক মাস সময় লাগবে। এ লক্ষ্যে প্রায় ৭০ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা শিগগির টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যাবে। শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল বলেন, চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট চালু করতে দুটি ইডিএস স্ক্যানার, আধুনিক কার্গো শেড এবং অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানের কার্গো অপারেশনের উপযোগী হয়ে উঠবে। ফেব্রুয়ারি নাগাদ এসব কাজ শেষ হওয়ার আশা করছি। জানা গেছে, এরই মধ্যে কোরিয়ান কোম্পানি ইয়াং ওয়াং গ্রুপ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট চালুর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা উন্নয়নের জন্য একটি ইডিএস স্ক্যানার দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে। এছাড়া চীনের একটি এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানও ফ্লাইট চালুর আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রথম পর্যায়ে সপ্তাহে দুটি কার্গো ফ্লাইট চালুর প্রস্তাব এসেছে, যা উজবেকিস্তান ও চীনের রুট হয়ে ইউরোপে পৌঁছাবে। তবে সরাসরি ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পাঠাতে এখনই সক্ষম নয় শাহ আমানত বিমানবন্দর। ইডিএস স্ক্যানার না থাকায় রপ্তানি পণ্য মধ্যপ্রাচ্যের কোনো বিমানবন্দরে স্ক্যানিং শেষে গন্তব্যে পাঠানো হয়। এতে রপ্তানিকারকদের খরচ ও সময়- দুই-ই বাড়ছে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ফ্লাইট চালু হলে সময় ও খরচ কমবে। বর্তমানে পণ্য ঢাকায় নিয়ে গিয়ে পাঠাতে হয়, এতে পরিবহন ব্যয় বাড়ে এবং সময়ও নষ্ট হয়। সরাসরি ফ্লাইট চালু হলে চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চল থেকে দ্রুত পণ্য পাঠানো সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, সরকার চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। তবে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে বিমানবন্দরের অবকাঠামো ও কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২৭০ টন ধারণক্ষমতার নতুন কার্গো শেড নির্মাণ এবং স্ক্যানার মেশিন ক্রয়ের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ সংক্রান্ত ৭০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী টেন্ডার প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক হওয়ায় সময় লাগছে। কর্মকর্তারা আরও জানান, আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হলে শুধু অবকাঠামো নয়, প্রশিক্ষিত জনবলও প্রয়োজন। নিরাপত্তা মানদণ্ড পূরণে আরএ-৩ সার্টিফিকেশন অর্জন করতে হবে। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তা স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী অনুমোদিত একটি ব্যবস্থা, যা ইউরোপে পাঠানোর উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করা কার্গোকে নিরাপদ হিসেবে সার্টিফাই করে। সব মিলিয়ে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট চালুর উদ্যোগে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবায়নে ধীরগতি প্রকট। ফেব্রুয়ারি নাগাদ কাজ শেষ হওয়ার আশা করা হলেও অবকাঠামো উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ না হলে এই উদ্যোগ আরও পিছিয়ে যেতে পারে। একবার চালু হলে চট্টগ্রাম শুধু দেশের নয়, আঞ্চলিক বাণিজ্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে বলে আশাবাদ সংশ্লিষ্টদের।