জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতিত্বে চলছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ চূড়ান্তকরণ নিয়ে কঠোর আলোচনা। যদিও বিএনপি ইতোমধ্যে সনদে মতামত প্রদান করেছে, জামায়াতে ইসলামি, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্তত ১৩টি রাজনৈতিক দল এখনও তাদের বক্তব্য জানাননি। এ দলগুলো দাবি করছে, সনদের আগে অবশ্যই সাংবিধানিক মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন, যা নির্বাচনের আগে সম্পন্ন হতে হবে এবং নির্বাচন অবশ্যই সনদের অধীনে আয়োজন করতে হবে।
রোববার সংসদ ভবনে কমিশনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পুনরায় আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠকের পরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। তারা জানান, বৈঠকের ফলাফল সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে জানানো হয়েছে।
কমিশনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সনদে স্বাক্ষর সম্পন্ন করা, পরে সেটি ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু খসড়া এখনও চূড়ান্ত না হওয়ায় ১৫ আগস্ট কমিশনের মেয়াদের মধ্যে সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। মনির হায়দার জানান, সব দলের মতামত নেওয়ার পর খসড়া তৈরি করা হবে, তারপর তার বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা ও চূড়ান্তকরণ হবে। আশা করা যাচ্ছে, কমিশনের মেয়াদের মধ্যে এসব কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, দলটি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সনদ নিয়ে কাজ করছে এবং কয়েকদিন সময় লাগবে। তাদের প্রধান দাবি সনদ নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন এবং পরবর্তী সংসদে সংবিধান সংস্কার অনুমোদন। সনদে যদি বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পথ না থাকে, তারা সনদে সই করবে না।
এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিনও নির্বাচনের আগে সনদে মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের পক্ষে অবস্থান জানান। তারা কমিশনের প্রস্তাবিত ছয়টি সংস্কার পদ্ধতির মধ্যে গণভোট, গণপরিষদ ও পরবর্তী সংসদের মাধ্যমে সংস্কারের বিকল্পগুলোর মধ্যে গণপরিষদের প্রতি বেশি ঝুঁকে আছেন। এনসিপির বক্তব্য, নির্বাচনের আগে সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে, সনদের অধীনে ভোট অনুষ্ঠিত হবে—এসব বিষয় তাদের মতামতে স্পষ্ট থাকবে।
চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনও একই দাবি করে, নির্বাচনের আগে পিআর ও মৌলিক সংস্কার নিশ্চিত না হলে তারা সনদে সই করবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দল ইতোমধ্যে সনদে মতামত দিয়েছে এবং যখনই আলোচনা হবে তারা অংশ নেবে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, বিএনপি ও অন্যান্য ১৬-১৭ দলের মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে, বাকিদের মতামত নিয়ে খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। এরপর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দলের সঙ্গে আলোচনা চলবে।
সনদ ছাড়াও জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়েও দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দিবসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন। এর প্রস্তুতিতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সাজসজ্জার কাজ চলছে এবং দেশের বাইরে থেকে ছাত্র-জনতার যাত্রার জন্য ট্রেন ভাড়া করা হয়েছে।
তবে গণঅধিকার পরিষদ ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে আলোচনা না হওয়ায় অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরকার ১৪ জানুয়ারি ঘোষণাপত্রের প্রথম খসড়া প্রকাশ করে ৩২ দলের মতামত নেয়। কিন্তু পরবর্তী আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়। গত ১৩ জুলাই বিএনপি ও এনসিপিকে খসড়া পাঠানো হয়, পরে জামায়াতসহ কিছু দলকেও পাঠানো হয়। ২৭ জুলাই চূড়ান্ত খসড়া দলগুলোকে পাঠানো হয়েছে, তবে চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রের বিস্তারিত দলগুলোর সঙ্গে শেয়ার করা হয়নি।
এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার পাশে সব দল থাকবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। বিএনপির এক নেতা জানান, তাদের মতামত প্রতিফলিত না হলে তারা অনুষ্ঠানে অংশ নেবে কিনা বিবেচনা করবে।
জামায়াতের নায়েবে আমির ড. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ঘোষণাপত্রে জনগণের মতামত প্রতিফলিত থাকতে হবে এবং সেটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেতে হবে। এনসিপিও একই দাবি জানায়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ২ জুন থেকে ২৩ দিন ধরে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে সনদের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেছে। এতে রয়েছে সাত দফা অঙ্গীকার, যেখানে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এই সংস্কার বাস্তবায়নে আগামী সংসদ নির্বাচনে গঠিত সরকার দুই বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় আইনি ও সাংবিধানিক সংশোধন করবে।
তবে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কিছু দল দাবি করছে, সনদ বাস্তবায়নে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা প্রয়োজন। তারা সতর্ক করেছে, যদি এসব না থাকে তবে সনদে সই করা হবে না।
বিএনপি চারটি সংস্কারের বিষয়ে একমত না হলেও তিনটিতে আপত্তিসহ সম্মত হয়েছে। জামায়াত একটিতে রাজি হয়নি। দলগুলো জানিয়েছে, তারা ক্ষমতায় গেলে যেসব সিদ্ধান্তে রাজি হয়নি সেগুলো বাস্তবায়ন করবে না।
বিশেষ করে ভোটের অনুপাতে (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদ না থাকা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), মহাহিসাব নিরীক্ষক (সিএজি) ও ন্যায়পাল নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে বিএনপি রাজি হয়নি।
অন্যান্য দল যেমন জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন ও গণঅধিকার পার্টি বলছে, এসব বিষয়ে ঐকমত্য না হলে সনদ অর্থহীন হবে এবং আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়া এটি কেবল একটি দলিল হিসেবে থাকবে।