বন্ধুত্বের নাম মোস্তফা
বিশ্ব বন্ধু দিবসে এক সাহসিকতা, এক ভালোবাসার সংজ্ঞা
বন্ধুত্বের আসল মানে কখনো কখনো একটি মুহূর্তেই ধরা দেয়—যখন শব্দ থেমে যায়, চোখে জল এসে দাঁড়ায়, আর হৃদয় বলে ওঠে “এটাই বন্ধুত্ব!”
২০২৪ সালের ২১ জুলাই, রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে ছিল ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. আরমান হোসেন মোস্তফা। হঠাৎই তার সামনেই বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। মুহূর্তেই চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, আতঙ্কে ছুটে বেড়ায় সহপাঠীরা। কিন্তু মোস্তফা ছুটে যায় আগুনের দিকে।
রক্তাক্ত, পোড়া অবস্থায় একজন সহপাঠী পড়ে আছে মাটিতে। মোস্তফা তাকে ধরে চিৎকার করছে, সাহায্যের জন্য ডাকছে—“কেউ নেই? কেউ আসুন! আমার বন্ধু, প্লিজ!”
এই দৃশ্য ধারণ করা একটি ভিডিও থেকে নেওয়া ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। ছবির নিচে কেউ একজন ক্যাপশন দেয়—
‘আমার বন্ধু আমাকে দেখে হাসল এবং বলল, আমি জানতাম তুমি আসবে।’
এই একটি লাইন যেন ধাক্কা দেয় হাজারো হৃদয়ে। বন্ধুত্ব কী, সাহস কাকে বলে, দায়িত্ব কতটা গভীর হতে পারে—সব প্রশ্নের উত্তর হয়ে দাঁড়ায় মোস্তফা।
বন্ধুত্ব মানেই পাশে থাকা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা
বিশ্ব বন্ধু দিবস আজ। এই দিনটি পালিত হয় বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও স্মৃতিকে স্মরণ করার জন্য। বন্ধুত্ব মানে শুধু একসঙ্গে সময় কাটানো নয়—বন্ধুত্ব মানে বৃষ্টিতে ভিজে কারও পাশে দাঁড়িয়ে যাওয়া, বিপদে পড়ে কারও হাত ধরা, কোনো দাবি ছাড়াই ভালোবাসা দেওয়া।
বন্ধু মানে তৃষ্ণার্ত জীবনে এক আঁজলা শীতল জল।
বন্ধু দিবসের ইতিহাস
বন্ধু দিবসের সূচনা হয় যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৩৫ সালে। এক বন্ধুর আত্মত্যাগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন কংগ্রেস আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’ ঘোষণা করে। পরে ২০১১ সালে জাতিসংঘ ৩০ জুলাইকে ‘আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশে, আবেগ ও আনন্দে এই দিবসটি পালিত হয় আগস্টের প্রথম রোববার।
আন্দোলনের রাজপথেও বন্ধুত্বের নতুন সংজ্ঞা
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলন নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে ‘বন্ধু’ শব্দটির মানে। একে অপরের অপরিচিত হলেও ছাত্র, চাকরিজীবী, দিনমজুর—সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন একসঙ্গে।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুজাইফা, আবীর, বাবলু, রতন, শামীম, সুবর্ণা, কবির—তারা শুধুই সহপাঠী ছিলেন না, তারা হয়ে উঠেছিলেন একে অন্যের ঢাল। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন গুলির মুখে। দেয়ালে দিয়েছেন স্লোগান, শহীদদের ছবি এঁকেছেন, বন্ধুদের জন্য দৌঁড়েছেন হাসপাতাল থেকে মর্গ পর্যন্ত।
এই সম্পর্ক কোনো ফেসবুক ‘ফ্রেন্ড লিস্ট’-এ থাকে না, এটি থাকে হৃদয়ের গভীরে।
বন্ধুত্বের নানারঙ
বন্ধু দিবস মানেই শুধুই চোখের জল নয়, আছে আনন্দ আর উদযাপনও।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তন্ময় হালদার আজ বন্ধুদের নিয়ে যাচ্ছেন পাহাড়ে—তাদের একসঙ্গে কাটানো সময়টা রঙিন করে তুলতে।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী রফিকুল ইসলাম জানান, বন্ধুদের নিয়ে অফিস শেষে আয়োজন করছেন সংগীত সন্ধ্যার। “ক্যাম্পাসে গান করতাম, আজ আবার সেই পুরোনো রিহার্সালের মতো হবে,” বললেন তিনি।
মাজহারুল আবেদিন মারুফ এই দিনটির জন্য কিছুদিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বন্ধুদের পুরোনো ছবিগুলো প্রিন্ট করে বানাচ্ছেন একসঙ্গে কাটানো সময়ের অ্যালবাম। “ওরা দেখে অবাক হবে, জানি!”
গৃহবধূ সাবিহা নওয়ারা নিজ হাতে বানাবেন কেক। “ইউটিউব দেখে শিখেছি। আজ বিকেলে বন্ধুরা আসবে, কেক কাটব, গল্প করব,” বললেন হাসিমুখে
স্মৃতি নয়, সম্পর্কই উপহার
বন্ধু দিবসে অনেকে ফুল, চকলেট, মগ বা বই উপহার দেন। কিন্তু আসল উপহার হলো—সময়, সঙ্গ, আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।
বন্ধুত্বের কোনো শেষ নেই, বন্ধুর প্রয়োজন নেই কারণের। সেই তো কবি লিখেছেন:
‘বন্ধু হে আমার, বন্ধু হে আমার, প্রেমেরই বাঁধনে বাঁধা তুমি আমার।’
বন্ধু দিবসের এই দিনে একটিই অনুরোধ
ভেবে দেখো—তোমার বন্ধু কোথায় আছে? কেমন আছে? হয়তো কারও খুব দরকার তোমার একটা ফোন কল, একটা মেসেজ, একটা “ভালোবাসি বন্ধু” বলা।
আজ শুধু হাসির দিন নয়, এই দিনটি হোক বন্ধুত্বকে শ্রদ্ধা জানানোর দিন।
আর যদি মোস্তফার মতো কারও পাশে একবার দাঁড়াতে পারো—তাহলেই তুমি সত্যিকার বন্ধু।