গাজায় মৃত্যুর মিছিল থামছে না। প্রতিদিন নতুন করে যুক্ত হচ্ছে শিশু, নারী, কিশোর ও বৃদ্ধের লাশ। ইসরায়েলি বিমান, ড্রোন ও কামানের আগুনে পুড়ছে ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল আর আশ্রয়কেন্দ্র। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ছে আর্তনাদ। অথচ গোটা দুনিয়া, যাকে আমরা ‘সভ্য বিশ্ব’ বলে চিনি—তারা দাঁড়িয়ে দেখছে। কেউ দেখছে নীরবে, কেউ সমর্থন দিয়ে।
একটা প্রশ্ন আজ বারবার উঠে আসছে—এই কি সেই মানবসভ্যতা, যে সভ্যতা ২১ শতকের? যে সভ্যতা চাঁদে যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বানায়, শান্তির বার্তা দেয়—সে সভ্যতা আজ শিশু হত্যার লাইভ সম্প্রচার দেখছে, আর মুখে এক ফোঁটা প্রতিবাদের ভাষাও আনছে না।
নীরব গণহত্যা, মুখোশপরা বিশ্ব
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র—সকলেই জানে গাজায় কী ঘটছে। কিন্তু তাদের বিবৃতি কেবল ‘উদ্বেগ’, ‘দুঃখ’ আর ‘উভয়পক্ষের সহিংসতা’য় সীমাবদ্ধ। বাস্তবতা হচ্ছে, “উভয়পক্ষের” কোনো সহিংসতা এখানে নেই। একপক্ষের আছে মার্কিন সমর্থিত যুদ্ধযন্ত্র, আরেকপক্ষের হাতে আছে শুধু পাথর, কাঁধে কফিন আর মুখে স্বাধীনতার শ্লোগান।
ইসরায়েল দিনরাত গাজার ওপর বোমাবর্ষণ করছে। ত্রাণবাহী ট্রাক আটকে রেখে অভুক্ত রাখছে হাজারো পরিবারকে। মিসর সীমান্তে লাইনে দাঁড়ানো শিশুদের দিকে তাক করেও গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন নেই, পানি নেই, খাবার নেই। চিকিৎসকরা হাত দিয়ে রক্ত থামানোর চেষ্টা করছেন। শিশুদের কাটা শরীর জোড়া লাগাতে হচ্ছে মোমবাতির আলোয়।
মৃত্যুফুলে ফোঁটা শিশুরা
গত কয়েক মাসে গাজায় নিহত হয়েছে অন্তত ১৫ হাজার শিশু। এ সংখ্যা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়—প্রতিটি সংখ্যার পেছনে রয়েছে একটি স্বপ্ন, একটি পরিবার, একটি ভবিষ্যৎ। ছোট্ট ইয়াসমিন, বয়স ৪। জন্মদিনে একটি পুতুল চেয়েছিল, তার বদলে পেয়েছে কবর। ৭ বছর বয়সী আয়মান—স্কুলে প্রথম হয়েছিল, স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। আজ সে নিজেই হয়ে গেছে যুদ্ধের শিকার। এমন হাজারো নাম, যাদের কেউ আর মনে রাখবে না, যদি আমরা লিখে না রাখি।
গাজায় শিশুদের খাওয়ার কিছু নেই। অনেক পরিবার ৩ দিন ধরে শুধু লবণ-পানি খেয়ে বেঁচে আছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম “আলজাজিরা” জানিয়েছে, পুষ্টিহীনতায় একের পর এক শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। অনেক মা দুধ দিতে পারছেন না, তাদের শরীরেও কোনো খাবার পৌঁছায় না।
স্বাধীনতার অপরাধে গুলি
ফিলিস্তিনি হওয়া আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধ। কারণ ফিলিস্তিনি হলেই তোমার মাথার ওপরে ড্রোন উড়বে, ঘুমের মধ্যে ঘর উড়ে যাবে, আর যখন খাবার চাইবে—তখন তোমাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হবে।
ইসরায়েলি বাহিনী প্রতিদিন ত্রাণ নিতে আসা নিরীহ মানুষদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তারা জানে—ক্ষুধার্ত মানুষের কণ্ঠ সবচেয়ে জোরালো। তাই সেই কণ্ঠকে তারা স্তব্ধ করে দিতে চায়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে ত্রাণের জন্য দাঁড়ানো অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছে ১৩০০ জন। কি নিষ্ঠুর পরিহাস—ত্রাণের জন্য দাঁড়ানো মানুষদেরও যেন মৃত্যুর লাইনে দাঁড় করানো হচ্ছে।
‘গাজা মুক্ত করো’—এটাই কি অপরাধ?
ইসরায়েল যা করছে, তা কেবল যুদ্ধ নয়, এটি একটি পরিকল্পিত জাতিগত নির্মূল। তারা গাজার জনসংখ্যাকে ধ্বংস করতে চায়। শিশুদের মেরে, নারীদের বিধবা করে, ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে তারা গাজাকে জনশূন্য করতে চায়। এটা আর যুদ্ধ নয়—এটা একটি ধ্বংসযজ্ঞ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
অনেক পশ্চিমা মিডিয়া হামাসের অস্ত্রের কথা বলে এই আগ্রাসনের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করায়। অথচ বাস্তবতা হলো, গাজার সাধারণ জনগণ—তারা কোনো সন্ত্রাসী নয়। তারা কেবল বাঁচতে চায়। গাজা মুক্ত করতে চায়।
একজন ফিলিস্তিনি তরুণের প্রশ্ন ছিল—“আমার বোনকে যখন বোমায় উড়িয়ে দেওয়া হলো, তখন আমি কী করতাম? চুপ করে থাকতাম?” এ প্রশ্নের উত্তর আজও দেয়নি কেউ।
ইতিহাস মনে রাখবে না, গাজা মনে রাখবে
পশ্চিমারা ইতিহাস লিখে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা রক্ত দিয়ে ইতিহাস গড়ছে। আজ যারা গাজায় নীরবতা দেখাচ্ছে, কাল ইতিহাস তাদের দোষী করে লিখবে—“তারা ছিল, কিন্তু কিছুই করেনি।”
গাজার আজকের কান্না আমাদের বিবেকের পরীক্ষা। যে সভ্যতা এই হত্যাযজ্ঞ দেখে চুপ থাকতে পারে, সে সভ্যতা আসলে মৃত। আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে—আমরা জানি কী হচ্ছে, তবুও চুপ। এই চুপ থাকার দায় একদিন আমাদের সন্তানেরা জিজ্ঞেস করবে—“তোমরা কিছু করনি কেন?”
শেষ নয়
গাজা এখনো বেঁচে আছে। প্রতিদিন ধ্বংসের মধ্যেও যখন কেউ বলেন “ফ্রি প্যালেস্টাইন”, তখনই গাজার হৃদয় আরেকবার ধুকপুক করে। এই মানুষগুলো মরেনি, তারা দাঁড়িয়ে আছে। যতদিন তারা দাঁড়িয়ে থাকবে, ততদিন গাজা পতন মানবে না।
গাজা শুধু একটি ভৌগোলিক জায়গা নয়। এটি এখন প্রতিরোধের প্রতীক। গাজা মানে সাহস, গাজা মানে সব হারিয়েও মাথা উঁচু রাখা। আর তাই, গাজা যদি আমাদের নীরবতায় মরে যায়, তাহলে আমরা সবাই হেরে যাব।